ফুলের রাজধানী গদখালী—এ নামেই বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার ‘গদখালী’ গ্রাম সুপরিচিত।
জেলা শহর থেকে বেনাপোলের দিকে ১৮ কিলোমিটার এগুলেই গদখালী বাজার। এখানেই গড়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুলের রাজধানী।
এ-এক উন্মুক্ত ফুলের হাট বা বাজার, দূর-বিস্তৃত। গদখালীর আশেপাশে ৯০টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার বিঘা জমিতে আধুনিক পদ্ধতিতে ফুল চাষ করা হয়।
যশোর থেকে ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার, উল্লিখিত ৯০টি গ্রাম এ দুই থানার অন্তর্ভুক্ত।
মনে রাখার বিষয় : গদখালী গ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা মূল্যের ফুল উৎপাদন হয়। এই গ্রামের ফুল সারাদেশ তো বটেই, যাচ্ছে বিদেশেও।
ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার গ্রামগুলোর রাস্তার দুইপাশে দিগন্তবিস্তৃত জমিতে লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুলের সমাহার দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতে হয়।
এ ছাড়া ফুলের সুঘ্রাণ, মৌমাছির গুঞ্জন, আর রঙিন প্রজাপতির ডানায় ভর করে এখানে আসে চিরন্তন সুন্দরের বারতা।
দিগন্তজোড়া জমিতে চাষ করা হয় রজনীগন্ধা, গোলাপ, গ্লাডিওল্যাস আর গাঁদা ফুল প্রভৃতি। সেখান থেকে ফুল সংগ্রহ করে গরুর গাড়িতে গদখালী বাজারে নিয়ে আসা হয়।
গদখালী থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায় ফুলের রাজধানীর সৌরভ।
গদখালী যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস। এখন প্রায় সারা বছরই বাহারি ফুলের সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।
ফুলের রাজধানী গদখালী
এখানে কোন ধরনের ফুল বেশি হয়
গদখালীর যে কোনো দিকে তাকালেই চোখে পড়ে একটার পর একটা ফুলের বাগান। বিশেষ করে গোলাপ, গাঁদা আর অর্কিড, পাতাবাহার, রজনীগন্ধার বাগান রয়েছে অসংখ্য।
এর বাইরেও চোখে পরে পলি হাউজ বা ফুল চাষের বিশেষ ঘর।
এসব ঘরে হয় জারবার ফুলের চাষ, যার চাহিদা এখন অনেক বেশি। স্থানীয় চাষীদের একজন জানান, এসব ফুলের বাইরেও লিলিয়ামসহ নানা জাতের ফুল চাষ করছেন তারা।
জানা যায়, গদখালীতে ভারত ও চীন থেকে বিশেষজ্ঞ চাষীরা এসেও স্থানীয় কৃষকদের সহায়তা করেন।
আরেকজন কৃষকের কাছ থেকে জানা যায়, নিত্য নতুন জাতের ফুলের চাষের জন্য আলাদা জ্ঞানের দরকার হয় এবং সেটি তারা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পাচ্ছেন।
এর ফলে ফুলের বাজার এখন গোলাপ, গাঁদা আর রজনীগন্ধার ওপর নির্ভরশীল নেই।
.
কৃষকরা কেমন লাভবান হচ্ছেন?
স্থানীয়রা জানান, ধান ও পাটের চেয়ে ফুলেই বেশি লাভ, আর এখন অনুষ্ঠান বা দিবস বেশি হয় বলে ফুলের চাহিদাও অনেকে বেড়েছে।
জানা যায়, ফুলের বাজার ঠিক রাখতে নিত্য নতুন ফুলের জাত নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি গবেষণাও শুরু হয়েছে। এর ফলে ফুল চাষে সম্পৃক্ত হওয়ার সংখ্যাও প্রতিবছরই বাড়ছে।
.
গদখালীতে ফুল চাষের ইতিহাস
গদখালীতে ফুল চাষ শুরু হয়েছিল কিভাবে? তার খোঁজ পাওয়া যায়, সেখানকার প্রবীণ চাষী শের আলী সরদারের কাছ থেকে।
তিনি জানান, চার দশক আগে তার হাত ধরে এখানে শুরু হয় ফুল চাষ। এভাবে এলাকার ক্ষেতখামার থেকে বিদায় নিতে শুরু করে ধান পাট বা এ ধরনের প্রচলিত শস্য।
তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে এক বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার ভাষ্যমতে, আমার বাবার নার্সারি ছিল এবং আমি সেখানেই বসেছিলাম।
ভারত থেকে আসা এক ভদ্রলোক এসে পানি চেয়েছিল। তার হাতে ফুল। তিনি বললেন, এই ফুল পশ্চিমবঙ্গে অনেক হয়।
আমি ভাবলাম, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মাটি তো এক। তখনই শুরু করলাম রজনীগন্ধা দিয়ে।
শের আলী সরদার ও স্থানীয় অন্যদের কথায় জানা গেল,
এভাবে প্রায় চার দশক আগে ফুল চাষের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল—এখন তার বিস্তার ঘটেছে পুরো অঞ্চলে।
বর্তমানে এখানে চাষ হচ্ছে—নিত্য-নতুন নানা জাতের ফুল।
.
কিভাবে যাবেন?
রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক, রেল এবং আকাশপথে যশোর যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা থেকে যশোর, বাস : ঢাকার কল্যাণপুর, গাবতলী এবং কলাবাগান থেকে—
সোহাগ, গ্রিন লাইন, শ্যামলী এবং ঈগল পরিবহনের বেশকিছু এসি ও নন-এসি বাস যশোরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
মানভেদে যশোরগামী নন-এসি বাসের ভাড়া ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা।
ঢাকা থেকে যশোর, ট্রেন : ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে—
শনিবার ছাড়া সপ্তাহের ৬ দিন সকাল ৬টা ২০ মিনিটে আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস যশোর অভিমুখে যাত্রা করে।
এ ছাড়া আন্তঃনগর চিত্রা এক্সপ্রেসে সোমবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য ৬ দিন সন্ধ্যা ৭টার সময় যশোরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
এসব ট্রেনে শ্রেণিভেদে টিকেটের মূল্য—
শোভন ৩৫০, শোভন চেয়ার ৪২০, প্রথম শ্রেণি চেয়ার ৫৬০, প্রথম শ্রেণি বার্থ ৮৪০, স্নিগ্ধা এসি চেয়ার ৭০০ এবং এসি বার্থ ১২৬০ টাকা।
ঢাকা থেকে যশোর, বিমান : ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে—
রিজেন্ট এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ও নভো এয়ারের বিমান যশোরের উদ্দেশ্যে নিয়মিত চলাচল করে।
যশোর থেকে গদখালী : গদখালী যেতে যশোর বাসস্ট্যান্ড কিংবা যশোর শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে রিকশা ভাড়া নিয়ে লোকাল বাসস্ট্যান্ডে আসতে হবে।
লোকাল বাসস্ট্যান্ড থেকে গদখালী যাবার বাস পাওয়া যায়।
গদখালি পৌঁছে ফুলের চাষের জমি দেখার জন্য ভ্যান নেয়া যাতে পাড়ে। দরদাম করে এক ঘণ্টার জন্য ১০০-১৫০ টাকা লাগতে পাড়ে।
.
কোথায় থাকবেন?
রাতে থাকার জন্য যশোর শহরই উত্তম। এ ছাড়া ঝিকরগাছায় জেলা পরিষদের ২টি ডাকবাংলো রয়েছে।
যশোর শহরে থাকার জন্য উন্নতমানের হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে—
হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল, জাবির ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, হোটেল আর এস ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল শামস ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি।
এ ছাড়া যশোরে বেশকিছু সরকারি রেস্ট হাউস এবং মোটামুটি মানের আরো বেশকিছু হোটেল আছে।
.
কোথায় খাবেন?
যশোরে বেড়াতে গেলে সেখানকার বিখ্যাত জামতলার মিষ্টি, খেজুরের গুড়ের প্যারাসন্দেশ ও ভিজা পিঠার স্বাদ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত হবে না।
এ ছাড়া চার খাম্বার মোড়ের ‘জনি কাবাব’ থেকে কাবাব, ফ্রাই, চাপ বা লুচি খেতে পারেন।
সেই সাথে ধর্মতলার মালাই চা এবং চুক নগরের বিখ্যাত চুই ঝাল খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে ভুলবেন না।
সাধারণ খাবারের জন্য নানা রকমের খাবার হোটেল রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করবেন। শুভ কামনা…
—ডেস্ক শুভ ভ্রমণ