দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি – ২য় পর্ব
আফরোজা অদিতি
এই ‘লোকমাতা’ বা রাণী রাসমণি দাসী কে ছিলেন? তা জানতে হলে সেই অষ্টাদশ শতকের সময়ে যেতে হবে, যখন মেয়েরা ছিল সমাজ-সংসারের ঘেরাটোপে বন্দী! তাঁদের কোনো নিজের বাড়ি ছিল না; (তাঁরা ছিল শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর, আর বার্ধক্যে পুত্রের)।
সেই সময় স্বামীর চিতায় জীবিত স্ত্রীকে তুলে দেওয়া হতো। নারীকে জড়বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা হতো। তা ছাড়া ব্রাহ্মণ্যবাদ এতই প্রবল ছিল যে, ব্রাহ্মণ না-হলে পুরুষকেই হেনস্থা করা হতো;
সেখানে তো নারীর কোনো কথাই চলে না! আর ঠিক সেই যুগে শুদ্রের ঘরে জন্মেছিলেন রাণী রাসমণি। তিনি ছিলেন যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনি তেজস্বিনী, রূপবতী।
রাণী রাসমণি দাসী ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৯৩ সালে হালি শহরের এক গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বাবা হরেকৃষ্ণ দাস এবং মা রামপ্রিয়া দাসী।
সাত বছর বয়সে রাসমণি দাসীর মা মারা যান। রাণীর মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পিতাই তাঁকে বড় করে তুলেছিলেন।
তাঁর পিতা তাঁকে বড় করে তুললেও, রাণীই সংসার দেখভাল করতেন এবং তাঁর বাবার ভালোমন্দ বিষয়ে খেয়াল রাখতেন।
তাঁর বাবা হরেকৃষ্ণ ঘরামির কাজ করতেন। সেই যুগে হরেকৃষ্ণের পরিবারের মতো পরিবারে লেখাপড়ার কথা কেউ ভাবতে পারতো না, তবুও হরেকৃষ্ণ অল্পকিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন।
হরেকৃষ্ণ সারাদিন অন্যের ঘরের চালের বাতা বাঁধলেও, সন্ধ্যাবেলা প্রদীপের আলো এবং ধুনোর ধূঁয়ায় সংকীর্তন করতেন।
হরেকৃষ্ণ নিজে যেটুকু জেনেছিলেন অর্থাৎ বিদ্যাশিক্ষা করেছিলেন, সেটুকু দিয়েই তিনি রাসমণিকে শিক্ষা দিয়েছিলেন!
মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি হরেকৃষ্ণ মহাভারত পাঠ করতেন এবং লন্ঠনের মৃদু আলোয় তাঁর মহাভারত পাঠ সমাবেত গ্রামবাসী উঠানে বসে শুনতেন।
বৈষ্ণব ছিলেন হরেকৃষ্ণ। তিনি, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে তিলক ও মালা ধারণ করতেন। হরেকৃষ্ণ নিজের শিক্ষায় বড় করেছিলেন মেয়েকে;
মেয়েও পিতার অনুরোধে ভক্তির এই ভাব-নিষ্ঠা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিষ্ঠাভরে পালন করতেন। রাসমণি অন্য সকলের সঙ্গে মহাভারতের কাহিনী শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন।
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি – ২য় পর্ব
রাসমণির মা ছিলেন না বলেই যে তিনি অযথা যেখানে সেখানে ঘুরে সময় নষ্ট করতেন তা নয়;
তাঁর বাবা কাজে বের হলে তিনি সংসারের সব কাজ সেরে তাঁর বাবার খাবার নিয়ে গিয়ে তাঁকে খাইয়ে গাছের ছায়ায় আনমনে ঘুরে বেড়াতেন কিংবা কোথাও আপন মনে বসে থাকতেন।
এমতাবস্থায় একদিন জানবাজারের জমিদার প্রীতরাম দাশ দেখেন রাণিকে এবং তাঁর ছেলে বাবু রাজচন্দ্রের জন্য পছন্দ করেন। রাসমণি ছিলেন অসামান্য সুন্দরী।
রাসমণির জগদ্ধাত্রীর মতো রূপ অর্থাৎ রাসমণির অসামান্য রূপ দেখে প্রীতরাম নিজেই রাসমণির সঙ্গে কথা বলেন।
নামধাম জিজ্ঞেস করেন। তাঁর সাবলীল কথা বলা, শিষ্টাচার, তাঁর সরলতা জমিদার প্রীতরাম বাবুকে মুগ্ধ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ছেলের বউ হিসেবে রাসমণিকে নির্বাচন করেন তিনি।
তাঁর পছন্দের কথা ছেলে বাবু রাজচন্দ্রকে না-বলে তাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ-ভ্রমণে পাঠিয়ে দেন।
বাবু রাজচন্দ্র দাশের পূর্বে আরো দুইজন স্ত্রী মারা যায়। পরিবারের মানুষ রাজচন্দ্রের বিয়ের জন্য চেষ্টা করছিলেন।
এমতাবস্থায় বন্ধুদের সঙ্গে বজরায় বেড়াতে গিয়ে ত্রিবেণী ঘাটে রাসমণিকে দেখে পছন্দ করেন তিনি।
বাবার পছন্দ আগেই হয়েছিল এখন ছেলের পছন্দ হওয়াতে বিয়ে হয়ে যায়; বিয়ের সময় ২১ বছরের যুবক ছিলেন বাবু রাজচন্দ্র।
রাসমণির বয়স মাত্র ১১ বছর। দরিদ্র এক ঘরামির মেয়ে হলো জমিদার বাড়ির পুত্রবধু।
প্রীতরাম ছিলেন জানবাজারের বিখ্যাত প্রজাবৎসল জমিদার। তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, দয়ালু, প্রকৃত একজন প্রজাপালক। কলকাতার জানবাজারে বিশাল অট্টালিকা ছিল তাঁর! আর হরেকৃষ্ণ ছিলেন ঘরামি যার স্থায়ী কোনো জীবিকা ছিল না।
কিন্তু তাঁর পরিবার ছিল সাত্ত্বিক পরিবার। সামাজিক পদমর্যাদায় প্রীতরামের সঙ্গে এবং হরেকৃষ্ণের আকাশপাতাল তফাৎ হলেও, দুজনেই ছিলেন ঐ শহরের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।
একজন ছিলেন শ্রদ্ধেয় ধর্মপ্রাণ জমিদার, অন্যজন ছিলেন শ্রদ্ধেয় কর্তব্যপরায়ণ ধর্মপ্রাণ গৃহস্থ।
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি – ২য় পর্ব
প্রীতরাম একজন ঘরামীর মেয়েকে কেন পুত্রবধু নির্বাচন করেছিলেন তার কারণ ছিল। কারণ প্রীতরাম শৈশবে ছিলেন অনাথ। রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এক পথশিশু।
দয়া করে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন হাওড়ার খোশলীপুরের অবস্থাপন্ন মান্না পরিবারের একজন বিধবা, বিন্দুবালা।
বিন্দুবালা দেবীর আরো দুইজন ভাইপো ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই একত্রে বেড়ে ওঠেন প্রীতরাম দাশ। তার পর জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে বিশিষ্ট ধনীদের একজন হয়েছিলেন তিনি।
প্রীতরাম দাশ যেমন ছিলেন সৎ পরিশ্রমী এবং কর্তব্যনিষ্ঠ, তেমনি ছিল তাঁর ঈশ্বরভক্তি।
তিনি জমিদার হলেও, তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ, দয়ালু, প্রকৃত একজন প্রজাপালক। শ্বশুরের মতো রাণী রাসমণিও ছিলেন প্রজাবৎসল, ধর্মপরায়ণ।
শুধু নামেই নয়, তাঁর ভক্তি, সেবা, অসাধারণ বুদ্ধি ও সাহসিকতায় এবং ঈশ্বরভক্তিতে তিনি একজন ঐতিহাসিক রাণী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
রাণী রাসমণি শুধু রাজচন্দ্রের স্ত্রী ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বামীর যথার্থ বন্ধু এবং পরামর্শদাতা।
তাঁদের সংসার ছিল সুখের। রাজচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি সম্মানও করতেন।
১৮১৭ সালে যখন প্রীতরাম দাশ পরলোক গমন করেন, তখন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে সাড়ে ছয় লক্ষ টাকার মালিক হন বাবু রাজচন্দ্র। তিনিই একমাত্র উত্তরাধিকারী ছিলেন।
বাবু রাজচন্দ্র শুধু ধনী ছিলেন না। তিনি ছিলেন শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত, বদান্য ও অমায়িক একজন আলোকিত মানুষ। উচ্চবিত্ত সমাজে ছিল তাঁর যাতায়াত, চলাফেরা।
সে-সময় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, অক্রুর দত্ত, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরসহ বিশিষ্ট বাঙালিদের সঙ্গে রাজচন্দ্রের ছিল সুসম্পর্ক।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম অংশীদার জন বেব সাহেব এবং লর্ড অকল্যান্ড-এর সঙ্গে ছিল সুসম্পর্ক। তিনি রায় বাহাদুর খেতাব পেয়েছিলেন।
বাবু রাজচন্দ্র যেমন বিশাল সম্পত্তির মালিক ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিশাল দাতা। ১৮২৩ সালে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বন্যা হয়।
তখন রাণীর অনুরোধেরই আর্তমানুষের সেবার জন্য ত্রাণশিবির খুলেছিলেন বাবু রাজচন্দ্র। রাণী রাসমণিই প্রথম আর্তমানুষের সেবাকেই ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ শিখিয়েছিলেন ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবার’ কথা।
রাণী রাসমণি, স্বামী সহায়তায় বন্যাপীড়িত গৃহহীন আর্তমানুষদের জন্য অর্থ ব্যয়ে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণশিবির খুলেছিলেন, এবং
তাঁরই সহায়তায় সহায়-সম্বলহীন মানুষ সেই প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি – ২য় পর্ব
যে বছর রাণীর পিতৃবিয়োগ ঘটে, সেই বছর পিতার চতুর্থি করতে ঘাটে গিয়ে ঘাটের বিপজ্জনক অবস্থা দেখতে পেয়ে বাবু রাজচন্দ্রকে ঘাট বাঁধিয়ে দিতে বললে—
রাজচন্দ্র রাস্তা ও ঘাট বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঘাট ও রাস্তা বাবুঘাট এবং বাবু রোড বলে পরিচিত।
রাণী রাসমণি শুধু বাবুঘাটই তৈরি করাননি, তিনি গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য আহিরীটোলাঘাট ও নিমতলাঘাট তৈরি করিয়েছিলেন।
সাধারণ তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি রাস্তাও তৈরি করে দিয়েছিলেন। শবদাহ করার জন্য নিমতলাঘাটে বড় একটি ছাউনি করে দিয়েছিলেন।
এ ছাড়া তিনি ইম্পরিয়াল লাইব্রেরি (ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) এবং হিন্দু কলেজ (প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার সময় অর্থ প্রদান করেছিলেন।
রাণী রাসমণি প্রজাদের হিতে নজর দিতেন সবসময়। পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর-জগৎশেঠ এবং বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবেব কাছের জনদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে—
নবাব সিরাজদৌলার পরাজিতের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে আসন গেড়ে বসে এবং শাসন করা শুরু করে।
অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ইংরেজদের শাসন-অত্যাচারের বিরোধিতা করেছেন রাণী রাসমণি।
ইংরেজ শাসনামলে একবার জেলেদের গঙ্গায় মাছ ধরার জন্য জলকর আরোপ করে ইংরেজ সরকার। রাণীর কাছে তাঁদের অর্থকষ্টের কথা বলে জেলেরা;
সেই কথা শুনে ঘুসুড়ি থেকে মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত ১০,০০০/- টাকা জলকর দিয়ে গঙ্গা ইজারা নিয়েছিলেন রাণী রাসমণি এবং দড়ি দিয়ে সেই স্থান ঘিরে দিয়েছিলেন।
এতে জাহাজ চলাচলের অসুবিধা হলে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে বাতবিতণ্ডায় রাসমণি বলেছিলেন, জাহাজ চললে মাছ পালিয়ে যাবে এবং জেলেদের অসুবিধা হবে, না-খেয়ে থাকবে তাঁরা।
প্রজাদের কষ্ট সহ্য করতে পারবেন না, তাই তিনি দড়ি খুলতে পারবেন না, যেহেতু জলকর দিয়েছেন; আইনত জায়গা তাঁদের।
রাণী রাসমণি কিছুতেই দড়ি খুলতে রাজী হননি, তখন ইংরেজ সরকার ১০,০০০/- ফেরত দিয়েছিলেন এবং জলকর তুলে নিয়েছিলেন।
.
মুকিমপুর, রাণীর শ্বশুরের ভিটে। সেখানে নীলচাষের জন্য যখন নীলকর সাহেবরা নীরিহ গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার শুরু করে, তখনো রুখে দাঁড়িয়েছেন রাণী রাসমণি।
গ্রামবাসীদের কাছ থেকে তাঁদের জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাধা দিয়ে নীলচাষ করার জন্য বাধ্য করতো নীলকর সাহেবরা।
অত্যাচারে বাধ্য করে কৃষকের জমি দখল করে নেওয়া, কৃষকদের নীলচাষে সম্মতি না-দিলে জমিতে সেচের পানি বন্ধ করে দেওয়ায় রাণীর কাছে এসে বললে—
রাণী রাসমণি জমিতে পানির দেওয়ার জন্য নিজ খরচে স্টোনার খাল খনন করে দেন। সেই খাল মধুমতি নদীর সঙ্গে নবগঙ্গার সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।
তিনি সোনাই, বেলিয়াঘাটা ও ভবানিপুরে বাসিন্দাদের সুবিধার জন্য বাজারও স্থাপন করেন। আর দক্ষিণেশ্বর মন্দির তো আছেই। দক্ষিণেশ্বর মন্দির দেবসেবার জন্য দানপত্র করেছিলেন,
আরো দিনাজপুর জেলার ঠাকুর গাঁ মহকুমার অন্তর্গত শালবাড়ি পরগণা, যেটি ২৬০০০/-টাকায় কিনেছিলেন, সেটিও দেবসেবার জন্য দানপত্র করেছিলেন।
সংকীর্ণ জাতপাতের উর্ধ্বে ছিলেন রাণী রাসমণি। তা ছাড়া রাণী সমাজ সংস্কারক হিসেবেও অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন।
সে-সময় শিশু বয়সেই (৮-৯) মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো। রাসমণি এর বিরোধিতা করেছিলেন এবং
নিজের বড় মেয়ে পদ্মমনিকে দুই বছরের বড় কিশোর রামচন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে ছিলেন বিধবা বিবাহ আন্দোলনে।
এইসব আন্দোলনে অর্থ সাহায্য করেছেন এবং সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
১৮৩৬ সালে বাবু রাজচন্দ্র মারা যাওয়ার পর তিনি জমিদারী চালাতে শুরু করেন এবং প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়েও, সাধারণ ধার্মিক বাঙালি হিন্দু বিধবার মতোই জীবনযাপন করতেন।
রাসমণির এই পর্যায়ে আসার জন্য তাঁর স্বামী বাবু রাজচন্দ্রের যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন।
১৮৬১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাণী রাসমণি দেবোত্তর সম্পত্তির দানপত্রে সই করেন এবং পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর অনুরোধেই তাঁকে গঙ্গাতীরে শুইয়ে দেয়া হয়। সেখানেই তাঁর দেহাবসান ঘটে।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি উচ্চকন্ঠে বলেছিলেন, ‘সরিয়ে দে, সরিয়ে দে, ও সব রোশনাই আর ভালো লাগছে না। এখন আমার মা আসছেন। তাঁর আলোয় চারদিক ভরে উঠেছে।’
ঐ দিন রাতের দ্বিতীয় প্রহরে তাঁর জীবানবসান ঘটে।
.
রাণী রাসমণি ও বাবু রাজচন্দ্র দাশের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। চারটি কন্যা : পদ্মমনি, কুমারী, করুণাময়ী ও জগদম্বা।
পদ্মমনির স্বামী রামচন্দ্র দাস, কুমারীর স্বামী প্যারীমোহন চৌধুরী, করুণাময়ীর স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাস।
বিয়ের কয়েক বছর পর করুণাময়ী মারা যায় এবং মারা যাওয়ার পর রাসমণির ছোট মেয়ে জগদম্বার সঙ্গে বিয়ে হয় মথুরামোহনের।
মথুরামোহন ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস ছেলে। ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাসের চার ছেলে : ব্রজগোপাল, নিত্যগোপাল, শ্রীগোপাল এবং গোপাল।
ওদিকে, ব্রজগোপালের দুই মেয়ে, লাবণ্যলতা এবং বিদ্যুৎলতা। লাবণ্যলতার স্বামীর নাম বিজয়কৃষ্ণ হাজরা। নিত্যগোপালের দুই ছেলে : সুশীল কুমার বিশ্বাস এবং সুনীল কুমার বিশ্বাস।
জানবাজারের জমিদার বাড়ি বর্তমানে ‘রাণী রাসমণি প্যালেস’ নামে পরিচিত।
.
আমরা যখন দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে যাই তখন গরমকাল। রাণী রানমণি রোড দিয়ে কিছুদূর গেলেই চত্বরের গেইট। গাড়ি রাখার জায়গাও আছে।
তখন বেলা ১১-১২টা হবে; মাথার ওপরে সূর্য! ড্রাইভার বলেছিল খালি পায়ে নামতে হবে, খালি পায়ে নেমেছিলাম!
উঃ, এতো গরম ছিল যে, মন্দির চত্বরের আশেপাশে পা রাখা যাচ্ছিল না। তবুও ঐ অবস্থাতে একটু ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
সপ্তাহের প্রতিদিন মন্দিরের দরজা ভোর ৫.০০টা থেকে রাত ৮.০০ পর্যন্ত খোলা থাকে। অনেকে পূজা দিচ্ছেন, মানত পূরণ করতে আসছেন।
এই মন্দিরের দেবী খুব জাগ্রত বলেই ধনী-গরীব সকলেই তাঁদের মানত রক্ষার্থে আসেন।
চত্বরের দেয়ালে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (ডাকনাম গদাধর ওরফে ছোট ঠাকুর)-এর পূর্ণায়বের ছবি আঁকা আছে।
গবেষকদের মতে, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব রাণীর স্নেহধন্য ছিলেন। তিনি এখানে কালীসাধনা করতেন। জ্ঞানীজনেরা অনেক অনেক গবেষণা করেছেন, করছেন।
রাণী রাসমণি দেবীও কালীভক্ত ছিলেন। জ্ঞানীজনদের মতে, জগন্মাতা (মা কালী) রাণী রাসমণির মাধ্যমেই এক ধর্মবিপ্লব ঘটিয়ে সব ধর্মের মিলনক্ষেত্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন—তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরকে।
তাই এতোবছর পরেও, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ও তাঁর ‘ভবতারিনী’ মায়ের টানে কতো মহাপুরুষ, কতো গৃহী, কতো ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ-শুদ্র, মুসলমান, খ্রিস্টান এখানে আসে। পূজা করে, ভক্তি করে।
দক্ষিণেশ্বর কালী টেম্পল অ্যান্ড দেবোত্তর এস্টেট-এর পক্ষ থেকে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেখানে সমাজসেবামূলক কাজকর্ম চলে।
ধন্য ‘লোকমাতা’, ধন্য রাণী রাসমণি, ধন্য দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির।তথ্যসূত্র : আলোকিত নারী যুগে যুগে; অন্তর্জাল এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।
(শেষ)
…………………
পড়ুন
অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকথা – ২য় পর্ব
ধন্যবাদ “শুভবাংলাদেশ”