ভ্রমণ কী কেন এবং এর উপকারিতা সম্পর্কে জেনে রাখা খুবই জরুরি। কারণ ‘ভ্রমণ’ মানুষের তুলনামুলকভাবে দূরতম ভৌগোলিক স্থানের মধ্যে গতিবিধি বা চলন নিয়ন্ত্রণ করে।

ভ্রমণ পিপাসুরা সাধারণত পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, গাড়িতে, ট্রেনে, নৌকায় কিংবা বিমানে ভ্রমণে যায়।

আদিম মানুষের মধ্যেই ছিল যাযাবর বৃত্তি। আজো মানুষ ভ্রমণ করতে ভালোবাসে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে।’

অন্যদিকে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা…’; অথবা, ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু…।’​

ভ্রমণ বা ট্রাভেল শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে, আদি ফরাসি শব্দ travail থেকে। মেরিয়াম ওয়েবস্টার ডিকশনারি অনুসারে যতদূর জানা যায়, ভ্রমণ শব্দটার ব্যবহার শুরু হয় চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে।

সেখানে এটাও বলা আছে, ভ্রমণ শব্দটা প্রথমে আদি ফরাসি শব্দ travailler (যার মানে পরিশ্রমের সাথে কাজ করা) হয়ে পরবর্তী সময়ে ইংরেজি শব্দ travailen, travelen-এর মধ্য দিয়ে উৎপত্তি লাভ করেছে।

ইংরেজিতে এখনো মাঝে মাঝে travail এবং travails শব্দ দুটো ব্যবহার করা হয়। [সূত্র : উইকিপিডিয়া]

ভ্রমণের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে—চিত্তবিনোদন, পর্যটন এবং অবকাশযাপন, তথ্য জড়ো করার জন্য ভ্রমণ গবেষণা, ছুটি কাটানোর জন্য ভ্রমণ,

দাতব্যের জন্য স্বেচ্ছাসেবক ভ্রমণ, অভিবাসনের কারণে অন্য কোথাও বসবাস শুরু করা, ধর্মীয় তীর্থযাত্রা, কোনো মিশনে যাত্রা, ব্যবসায়িক ভ্রমণ, বাণিজ্য বিনিময়।

এ ছাড়া অন্যান্য কারণ, যেমন চিকিৎসা অথবা যুদ্ধগ্রস্ত জায়গা থেকে আভিবাসী হওয়া, অথবা ভ্রমণ উপভোগ করার জন্যে।

ভ্রমণকে কেন্দ্র করে আজ দেশে দেশে পড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। অনেক দেশে পর্যটন অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় ও বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের একটি কার্যকর শিল্পখাত।

যার মধ্য দিয়ে বিশ্বে পর্যটন শিল্প একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে সুপরিচিত।

.

বাংলাদেশ অঞ্চলে ভ্রমণের সূত্রপাত

বাংলাদেশ অঞ্চলে ভ্রমণের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬০-এর দশকে। বিদেশ থেকে পর্যটকরা এখানে আসতো সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণে, এদেশের শ্যামল-সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

পূর্ববাংলার নদ-নদী, বনভূমি, পাহাড়ি অঞ্চল, ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থান, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক জীবন—সবই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

বাংলাদেশের সুন্দরবন—পৃথিবীর বৃহত্তম বনাঞ্চল। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে অনন্য ও একক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

.

ভ্রমণের গুরুত্ব ও উপকারিতা

আধুনিক গবেষণায় ভ্রমণের নানা কার্যকারিতা উঠে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য :

.

১. বুদ্ধির তীক্ষ্মতা বাড়ায়

খোলামেলা পরিবেশ আমাদের বুদ্ধির তীক্ষ্মতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়—যা চার দেওয়ালের আবদ্ধ পরিবেশে সম্ভব নয়।

Environmental Psychology Researchers-এর রিপোর্ট অনুযায়ী :

যিনি মাত্র ৪০ সেকেন্ডের জন্য একটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তিনি তার পরবর্তী কাজে ভালো ফল করেন।

.

২. মানবিক উদারতা বৃদ্ধি

নানা জাতি—নানা মত—নানা পরিধান-এর সঙ্গে পরিচিতি ঘটলে মানুষের মধ্যে মানবিকতা বোধ গড়ে ওঠে।

বিশেষ করে, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ভ্রমণ অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ভ্রমণের মাধ্যমে তাদের মধ্যে অন্য ধর্ম, সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে ওঠে।

.

৩. শিক্ষায় আগ্রহ

যে কোনো নতুনত্ব মানুষের কৌতুহল বাড়িয়ে দেয়। আর এই কৌতুহল বা ঔৎসুক্যই শেখার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।

আর নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমণ তাই মানুষকে প্রকৃতপক্ষে শিক্ষায় উৎসাহী করে তোলে।

.

৪. সৃজনশীলতা তৈরি

ভ্রমণ মানুষের মনের ভেতরে থাকা সৃজনশীলতাকে উস্কে দেয়। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নানা উপায় অবলম্বন করে থাকে।

তা দেখে ভেতরের শিল্পী মন জেগে ওঠে। নতুন নতুন সৃষ্টির বাসনা তৈরি করে।

.

৫. জীবনবোধ গড়ে তোলো

অচেনা-অজানা পরিবেশে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। ফলে গণ্ডিবদ্ধ জীবনে নিজের জীবনের অবস্থান সুস্পষ্ঠ হয় না।

সে কারণে দেখা যায়, ভ্রমণের ফলে আত্মজীবন, বিশ্বজীবন উপলব্ধি করার সুযোগ তৈরি হয়। তাই বলা হয়, ভ্রমণ মানুষের জীবনবোধ জাগ্রত করে।

.

৬. খুশি রাখে

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক অনুসন্ধিৎসু শিশু সত্তা। নতুনের আনন্দ মানুষের স্বভাবের অঙ্গ।

দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের মাধ্যমে বিমর্ষ ভাব কেটে যায়, আর মন খুশিতে ভরে ওঠে।

.

৭. ধৈর্য বাড়ায়

অচেনা-অজানা পরিবেশে নিজের প্রয়োজনের উপাদান জোগাড় করতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। সেখানে নিজের বাড়ির মতন রাগ দেখানোর উপায় থাকে না।

খুবই সত্যি কথা, ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষের ধৈর্য শক্তি বেড়ে যায়।

.

৮. সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি

ভ্রমণে নানা দেশে নানা ভাষার ভিড়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। চরম লাজুকও সেখানে বাঙময় হয়ে ওঠে।

বিভিন্ন ভাষা, পেশা, সামাজিক অবস্থানের মানুষের সঙ্গে পরিচিতি হবার পাশাপাশি ভ্রমণ সামাজিক দক্ষতা বেড়ে উঠতে সহায়তা করে। এমনকি যাত্রাকালে সহযাত্রীদের মধ্যেও সদ্ভাব গড়ে ওঠে।

.

৯. মানসিক চাপ কমায়

আগের দিনে মানুষের অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তার বায়ু পরিবর্তনের কথা বলতেন। এর মূল কারণ হলো : মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজনীয়তা।

মন খুশি হবার সাথে সাথে প্রতিদিনের জীবনের মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায় ভ্রমণের করার মাধ্যমে।

.

১০. ইতিবাচক চিন্তাসহায়ক

ভ্রমণ আপনাকে লক্ষ্য অর্জনেও সাহায্য করবে। ভ্রমণে ইতিবাচক চিন্তা বৃদ্ধি করে।

মনে করুন, পাহাড়ে ওঠার লক্ষ্য অর্জন করলে, আপনি হয়তো আবার একটি লক্ষ্য ঠিক করে নিবেন। এভাবে লক্ষ্য অর্জন আপনাকে দিতে পারে আত্মবিশ্বাস এবং সফলতা।

শত ব্যস্ততার মাঝেও ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস করুন। নিজে ভালো থাকবেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা ভালো থাকবে। তাই ভ্রমণকে জীবনের অংশ করে তুলুন।

—ডেস্ক শুভ ভ্রমণ

Spread the love