কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বিমান পথে ভ্রমণ, সড়ক পথে ভ্রমণ, সমুদ্র-সৈকত

সাগর জলে পা : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

Cox's Bazar Sea Beach

সাগর জলে পা : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

আফরোজা অদিতি

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

কক্সবাজার রওয়ানা দিয়েছিলাম ২০১৯ সালের সকালে ২৭ ডিসেম্বর। হোটেল বুকিং দেওয়া ছিল আগেই। এবারে চতুর্থবার কক্সবাজার যাওয়া। প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৯৫ সালে। সে-সময় গিয়েছিলাম ট্রেনে। ভোরে নেমে পতেঙ্গা বিচ ঘুরে চট্টগ্রামের আরো কিছু স্থান দেখে তার পর গিয়েছিলাম কক্সবাজার।

সেবার গিয়ে তো হোটেল পাই না। আমরা ‘নিরিবিলি’ নামে এক হোটেলে একটি রূম পেয়ে সেখানে ঢালাও বিছানা পেতে থেকেছিলাম।

সে খুব আনন্দের ব্যাপার। ‘নিরিবিলি’র নির্মাণকাজ তখনো শেষ হয়নি। কাজ চলছিল তবুও আমরা থাকার একটা জায়গা পেয়েছিলাম।

প্রথমবার যখন গিয়েছি, তখন সাগর সৈকতে এতো জনসমাগম ছিল না। তখন সাগরে যেতে ভালো লেগেছে।

দ্বিতীয়-তৃতীয়বারেও একটু বেশি মানুষ ছিল সৈকতে—যা দেখার দেখেছি প্রথমবার! তখন সাগর ছিল অচেনা; সাগর জলের সফেন ফেনাতে ছিল আকর্ষণ!

সৈকতের ছিপছিপ জলে দাঁড়িয়ে হাতের তালুতে অস্তগামী সূর্য ধরে এবং সূর্যের রঙে মন ভাসিয়ে দিতে ভালো লেগেছিল।

ভালো লেগেছিল, জোয়ারে ভেসে আসা ঝিনুক কুড়াতে। ঝাউবনের ধার দিয়ে হাঁটতেও ভালো লেগেছিল।

দ্বিতীয়বার ঢাকা থেকে সরাসরি গিয়েছিলাম বাসে; উঠেছিলাম হোটেল পালঙ্কীতে। দ্বিতীয়বারেও ঘুরেছি এখানে-ওখানে। ঝাউবনে হেঁটেছি, সকাল-বিকাল সাগরে এসেছি; সাগরের জোয়ারজলে সৈকতে হেঁটেছি, ঝিনুক কুড়িয়েছি। ছোট ছোট মেয়েদের কাছ থেকে মালা এবং পছন্দমতো জিনিস (স্যুভেনির) কিনেছি।

দ্বিতীবারের পরে শুধু রূমে থাকা আর সৈকতে গিয়ে ছাতার নিচে বসে সমুদ্র দেখা! সমুদ্র দেখার আনন্দ নিতেই তো যাওয়া; মন ভরে সেই আনন্দ নেওয়াও একরকম জীবনসাধনা বৈকি! কারণ আনন্দ খুব সহজপ্রাপ্য নয়! একা একা নিরিবিলি না-থাকলে কিন্তু আনন্দ পাওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়!

এখন তো কক্সবাজার সাগর সৈকতে থৈথৈ মানবসমুদ্র! অতোটা আনন্দ পাওয়া যায় না। তবে ব্যক্তিভেদে সুখ-আনন্দ পাওয়া ভিন্ন রকম!

.

আমাদের এবারের যাওয়া প্রথমবারের মতো নয়! এবারে রুমে রুমেই থাকা, খাওয়া-দাওয়া, বাইরে একটু হাঁটা-চলা করা আর সাগর সৈকতে গিয়ে ছাতার নিচে বসে থাকা!

নব্বইয়ের দশকে যখন গিয়েছিলাম, সৈকতে এতো ভিড় ছিল না, এখন তো ঘিঞ্জি পরিবেশ; আর যেতে ইচ্ছা করে না। তবুও সাগর দেখতে চাইলে তো এখানেই যেতে হবে, না-হলে চোখের জলেই সাগর দেখতে হবে।

আমাদের কক্সবাজার সাগরসৈকত ঘিঞ্জি হলেও, এর দৈর্ঘ ১২০ কিলোমিটার, পৃথিবীর দীর্ঘতম সাগরসৈকত। ইতিহাস বলে, প্রখ্যাত ব্রিটিশ নৌ-অফিসার হিরাম কক্সের নামানুসারে এই সৈকতের নামকরণ করা হয়েছে।

হিরাম কক্স বিট্রিশ হলেও, তিনি ছিলেন স্কটিশ। স্কটিশে তাঁর নাম হাইরাম কক্স। ১৭৭৯ সালে তিনি প্রথম ভারতে আসেন। ১৭৯৬ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের দূত হিসেবে রেঙ্গুনে নিয়োগ পান।

পরবর্তী সময়ে বার্মার উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব পেয়ে চট্টগ্রামে আসেন। তাঁর পোস্টিং হয় রামুতে। পুনর্বাসনের কাজ চলছিল সেই সময়েই তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

আরাকানদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন হিরাম কক্স। তাঁর মৃত্যুতে সাময়িকভাবে হলেও, উদ্বাস্তু-পুনর্বাসনের কাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

কারণ উদ্বাস্তু সমস্যা মোকাবেলা করার জন্যই উদ্বাস্তু ইমিগ্রেশন পদে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল চট্টগ্রামে।

সে যাই হোক, কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ যেখানে বসবাস করতেন, সেই স্থানকে আরাকানি ভাষায় স্থানীয়রা বলতো ‘কালকিৎ।’ হিরাম কক্স কালকিৎদের বসতি এলাকায় একটি বাজার বসিয়েছিলেন।

হিরামের মৃত্যুর পরে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিয়ে আসেন ঢাকার মি. কার।

মি. কার যখন দেখলেন ‘কালকিৎ’ এলাকায় একটি বাজার আছে, তখন তিনি হিরাম কক্সের নামানুসারে নামকরণ করলেন কক্স’স বাজার। সেই থেকে আমাদের কক্সবাজারের সঙ্গে হিরাম কক্সের নাম জড়িয়ে আছে।

.

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত সবচেয়ে সুন্দর ও পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত। বেশিরভাগ পর্যটক লাবনী পয়েন্টে ঘোরাফেরা করে।

এই বিচে আছে বিস্তৃত বেলাভূমি, ঝাউগাছের সারি, সৈকতে আছড়ে পড়া সাগর জলের ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে যায় যখন, তখন সেই জলে দাঁড়িয়ে সাগরে তপনদেবের রাঙা আলো খুব দৃষ্টিনন্দন মনে হয়।

এই সাগরসৈকতে এসে দাঁড়ালে পৃথিবীটাকে খুব সুন্দর মনে হয়। অনেক বছর বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা জাগে প্রাণে। এই জন্য সকলে আসে লাবনী পয়েন্টে। এ ছাড়া আছে কলাতলী বিচ, সুগন্ধা বিচ—এই বিচ দুটোতেও যায় অনেকে।

আমরা মহেশখালি গিয়েছিলাম নব্বই দশকে প্রথমবার। স্পিডবোটে গিয়েছিলাম মহেশখালি। তখন ছেলে-মেয়েরা ছোট ছিল।

ছোট মেয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল সারাক্ষণ। মহেশখালি একটি উপজেলা। এখানকার পান বিখ্যাত। সারি সারি পানের বরে ঝুলছে সবুজ পানপাতা।

দর্শনীয় স্থান আছে অনেকগুলো। আদিনাথ মন্দির, রাখাইন পাড়া, স্বর্ণমন্দির, মৈনাকপর্বত ইত্যাদি।

শীতের সময় গিয়েছিলাম। ঘন কুয়াশাঢাকা ঝাউবনের সারিতে নয়ন-মন দুটোই জুড়িয়ে যায়। আদিনাথ মন্দিরে ফাল্গুনে হয় শিবচতুর্দশীর মেলা। তখন দর্শনার্থীর ভিড়ও থাকে বেশি।

.

নব্বইয়ের পরে আর মহেশখালি যাওয়া হয়নি। এর পর সৈকতেই ঘুরেছি। পর্যটকদের আনন্দরূপ দেখেছি, ঘুড়ি উড়ানো আর সূর্যাস্ত দেখেছি। সূর্যদেবকে সাগরজলের ওপর ভেসে ভেসে ক্রমশ জলের বুকে তলিয়ে যেতে দেখেছি। মধুর দৃশ্য!

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত যেমন মায়াবী, তেমনি রূপময়ী। তবে ইদানীং নানা ধরনের দোকানপাট-মার্কেট এখানে গড়ে উঠেছে।

পর্যটন মৌসুমে পর্যটকদের পদচারণায় কক্সবাজারের প্রাণচাঞ্চল্য থাকে ঠিকই, তবে সৈকতের স্বাধীন-সত্তা খুব কষ্ট পায়!

টেলিভিশনে করোনাকালের ‘লকডাউনে’ পর্যটকবিহীন সৈকতে দেখেছি, বিভিন্ন রঙিন লতা-পাতা পুষ্পের বাহার। সাগরের জলও অমলিন। টেলিভিশনে দেখে ভালো লেগেছিল।

সে যাক, সমুদ্র দেখতে তো মানুষ যাবেই, কোলাহল হবেই। শুধু পর্যটক নয়, এখানে দুর্গাপূজার সময়ে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। মেলাও বসে। সৈকতের আর দোষ কী?

.

বালিতে হাঁটতে পারি না আমি। হাঁটতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। রাহগীর দৌড়ে এসে বলে, আমি ফুঃ দিয়ে দিবো, দেখবে ভালো হয়ে যাবে। ঐ ব্যথা তো এমনিতেই ভালো হবে, তবুও বললাম ঠিক আছে দাও।

ও ঘুড়ি ওড়ানো বাদ দিয়ে বলতে শুরু করে, ‘আতাজারা বাতাজারা/ বইন্দায়ে খাড়ানাড়া/ বক্কে আসলো খাড়ানাড়া/ ফুঃ’।

ওর কথা শুনে সকলেই হেসে কুটিপাটি। হাসি-আনন্দ নিয়ে হোটেলে এসে বিশ্রাম নিলাম। পরদিন যাবো বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক।

.

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক বা ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ৪৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

আটটি ব্লকে ডুলাহাজরা সাফারি পার্কটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্রসহ নানা প্রজাতির পশু-পাখি আছে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার, জিরাফ, ভালুক, চিতা, সিংহ, জলহস্তি, হাতি, গয়াল, কুমির, সাপ, বানর, বনগরু, শুকর, ময়ূর-সহ নানারকম পাখি এখানে দেখতে পাওয়া যায়।

এখানে হরিণ আছে কয়েক প্রজাতির, যেমন—মায়া হরিণ, সম্বর হরিণ, চিত্রা ও প্যারা হরিণ।

পার্কের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় পুরো পার্ক ঘুরে দেখা যায়; আমরা ঘুরলাম।

লম্বাগলা জিরাফের সজল চাহনি, জলহস্তির মুখ বের করে জলে ভেসে থাকা, হাতিদের মিলমিশ, পাখিদের কিচিরমিচির—সব মিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের ভালো লাগবে।

এই পার্কটি ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি দিন পশুপাখি আর সবুজের মধ্যে থাকলে মন আর চোখের আরাম হয়। পার্কের প্রবেশপথে তো প্রাণীর ভাস্কর্য আছেই, পুরো পার্কেই আছে নানাবিধ পশুপাখির ভাস্কর্য।

আছে শিক্ষাকেন্দ্র, প্রাকৃতিক-ঐতিহাসিক জাদুঘর। ডুলাহাজরা পার্ক ঘুরে ভালোই লেগেছে, যেমন লেগেছিল গাজীপুর সাফারিপার্কে।

.

সব ঘোরাঘুরি শেষ হলে আবার ঘাঁটিতে ফেরা, কারণ গিট্টু দেয়া আছে এখানেই। কক্সবাজার গেলাম সমুদ্র দেখে পা ভিজিয়ে জলের উষ্ণতা নিয়ে ফিরে এলাম ঢাকা।

তার পর জানুয়ারিতে অল্প অল্প কোভিড-১৯-এর কথা শোনা যাচ্ছিল বলে পুরো জানুয়ারি মাস বাসায় থেকে ২০২০ সালের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’তে কয়েকদিন গিয়েছিলাম।

কারণ গ্রন্থমেলা সবসময়ই টানে আমাকে! কিন্তু তার পর থেকেই তো আছি ‘লকডাউন’-এ।

২০২০ সাল তো গেল যেনতেন, ২০২১-এ তো বইমেলাতে যাওয়াই হলো না। এখন তো ঘরে বসে আছি, কিছুই করার নেই; মনে ভাবি এই অতিমারির ‘লকডাউন’-এর কয়েকদিন আগে তবুও খোলামেলা জল-হাওয়াতে ঘুরে আসতে পেরেছিলাম।

তথ্যসূত্র : মাথিনের কূপ : জয়নাল হোসেন; এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা

(শেষ)

…………………

পড়ুন

কবিতা

আফরোজা অদিতির পাঁচটি কবিতা

গল্প

রাত ভোর হতে আর কত দেরি

মুক্তগদ্য

অর্থ এক বিলাসী প্রেমিক

ভ্রমণ

গোকুল মেধ বা বেহুলার বাসরঘর

অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকথা

অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকথা – ২য় পর্ব

দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি

দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির ও রাণী রাসমণি – ২য় পর্ব

সাগর জলে পা

কুয়াকাটা সাগর সৈকত

সেন্টমার্টিন সাগর সৈকত

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

Spread the love

২ thoughts on “সাগর জলে পা : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

Leave a Reply

Your email address will not be published.